ভালোবাসার ঋণ, (ছোট গল্প )

ঝনঝন করে কাঁচ ভেঙে পড়ার শব্দে তড়াক করে উঠে পড়ল সুরমা। দারুন ত্রাসে বুকটা ধক করে উঠলো। হঠাৎ ঘুম ভাঙাতে বুঝে উঠতে পারছিল না কি ঘটেছে। কয়েক সেকেন্ড বিমূঢ় হয়ে বসে থেকে আবারো সেই ঝনঝনানি শুনতে পেলো । ..

ভালোবাসার ঋণ
ভালোবাসার ঋণ

বিশ্ব ভালোবাসা দিবস উপলক্ষ্যে আপনাদের জন্য আমার লেখা ছোট্ট একটা ভালোবাসার গল্প ।

ভালোবাসার ঋণ

আয়শা ছিদ্দিকা

১৪.০২.২০২১

——————————————-

ঝনঝন করে কাঁচ ভেঙে পড়ার শব্দে তড়াক করে উঠে পড়ল সুরমা। দারুন ত্রাসে বুকটা ধক করে উঠলো। হঠাৎ ঘুম ভাঙাতে বুঝে উঠতে পারছিল না কি ঘটেছে। কয়েক সেকেন্ড বিমূঢ় হয়ে বসে থেকে আবারো সেই ঝনঝনানি শুনতে পেলো । এবারে সে এই শব্দের উৎস খুঁজে পেলো। বিদঘুটে এই ঝনঝনানি আসছে তার নিজের মোবাইল থেকেই। 

অবাক হয়েই হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা টেনে নিল সুরমা। 

হাসি পেলো তার ..এলার্ম বাজছে। এলার্মের টিউনটি কাঁচ ভাঙার ঝনঝন শব্দের।

মনে পড়ে গেলো গত রাত্রে খেতে বসে সপ্তদর্শী কন্যা লোপা কে বলেছিল সকাল সকাল ডেকে দিতে।  

ক’টায় ডাকতে হবে?- লতি-চিংড়ির চচ্চড়ি দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে প্রশ্ন টা  ছুড়ে দিয়েছিলো লোপা।  

সাড়ে ৫ টার দিকে পারবি না? ৯টায় আমার ফ্লাইট। বাসা থেকে এয়ারপোর্টে পৌঁছাতেও মিনিট বিশেক লাগবে। আর যদি রাস্তায় জ্যাম থাকে তাহলেতো হয়েই গেলো। ভাবছি রাতেই সব গুছিয়ে রাখবো সকালে উঠে জাস্ট রেডি হয়ে চলে যাব। 

ঠিক আছে ডেকে দিবো। আর কি কি গোছাতে হবে আমাকে বোলো।  -চোখতুলে মিষ্টি হেসে উত্তর দিয়েছিলো লোপা।   

আস্তে করে বিছানা থেকে নেমে সন্তর্পনে পাশের ঘরের দরজা ঠেলে সুরমা দেখলো লেপ জড়িয়ে দিব্বি গুটিশুটি মেরে ঘুমোচ্ছে লোপা। দেখে মৃদু হাসি খেলে গেলো তার ঠোঁটে। 

গতকাল স্যুটকেস গোছাতে কি কি লাগবে তার বিবরণী জেনে নিয়ে সুরমাকে প্রায় ঠেলে ঠুলে ঘুমোতে পাঠিয়ে নিজেই সব গুছিয়ে রেখে দিয়েছে। আর এগুলো করতে করতেই হয়তো কিছুটা রাত করে ফেলেছিলো মেয়েটা।  তাই সতর্কতা হিসেবে এই এলার্মের ব্যাবস্থা। 

এলার্মের টুং টাং আওয়াজের কথা সুরমা শুনেছে কিন্তু এই রক্ত হিমকরা ঝনঝনানি আজ প্রথম দেখল। ভালোই করেছে লোপা নয়তো নভেম্বরের এই মৃদু শীতের সকালে আরামের ঘুম ভেঙে ওঠা কি চাট্টিখানি কথা? 

দ্রুত হাতে হাতমুখ ধুয়ে নিলো সে। তারপর আয়নার সামনে বসে নিজেকে সাজাতে বসলো। নাহ অনেক ভারী মেকআপ সে করবে না, করেও না তেমন একটা।  কিন্তু নিজেকে পরিপাটি করতে খুব ভালোবাসে। আর আজকাল করতেও হয়, কারণ এখন তো সে আর শুধু সুরমা নয়…এখন সে কণ্ঠশিল্পী সুরমা চৌধুরী। ভুবন বিখ্যাত না হলেও তার ভালো জনপ্রিয়তা আছে দেশে। মানুষজন তাকে চিনে। 

আর যাই হোক পথেঘাটে হুটহাট আলুথালু হয়ে তো বের হওয়া যায় না। আর সে আজ যাচ্ছে চট্টগ্রামে একটা লাইভ কনসার্টে গান গাইতে।  পৌঁছানোর পরেও অনেক লোক সেখানে থাকবে।  তাই মোটামুটি ভদ্রস্থ হয়েই যাওয়া দরকার। 

চোখে-ঠোঁটে-মুখে হালকা প্রসাধনী মেখে আলমারি খুলে নীল তাঁতের শাড়িখানা বের করে নিলো সে।  নীল জমিনে হলুদ আর বাসন্তী রঙের চমৎকার আঁকিবুকি।  গায়ে শাড়ি জড়িয়ে কপালে ছোট্ট একটা নীল টিপ বসিয়ে দিলো।  কানে গলায়  নীল পাথরের ছোট্ট দুল আর পেন্ডেন্ট। এক হাতে ঘড়ি আর অন্য হাতে রেশমিসূতার দুখানা নীল-হলুদ বালা।  

সাজ শেষ করে আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিলো। সন্তুষ্টির হাসি ফুটে উঠলো মুখে। নেই নেই করেও বয়েস এখন আটত্রিশের কোঠায়। তবু আয়নার মধ্যে খোলা চুলে নীল শাড়ীতে যাকে দেখতে পাচ্ছে কোনোভাবেই তাকে ত্রিশ-বত্রিশের বেশি বলা চলে না। 

ওমা তুমি রেডি হয়ে গিয়েছো মামনি….ডাক শুনে চমক ভেঙে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো সুরমা। 

ঘুম ঘুম চোখে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে লোপা।  

সুরমা হেসে জবাব দিলো “যা একখানা বিদঘুটে এলার্ম সেট করে দিয়েছিলি, ওটা শোনার পরেও আবার ঘুমায় কার সাধ্যি?”

হাসতে হাসতে লোপা বললো ”তাহলে এলার্ম কাজ করেছে, কি বলো?

হ্যাঁ এলার্ম কাজ করেছে, এখন তুইও ঠিকঠাক নিজের কাজ কর।  যেভাবে বলেছি ঐভাবে থাকবি। রাজার মাকে বলেছি আজ রাতে তোর সাথে থেকে যেতে।  আমিতো কাল দুপুর নাগাদ চলেই আসবো।  তবু যদি কোনো সমস্যা হয় আমাকে ফোন করবি নাহলে মামাকে জানাস।  মিরপুরেই তো থাকে চলে আসবে। ….গায়ে সুগন্ধি মাখতে মাখতে বলে চললো সুরভী। তারপর কাঁধে হাতব্যাগ ঝুলিয়ে টেবিল থেকে স্যুটকেসটা টেনে নামালো। 

লোপা ব্যাস্ত হয়ে বললো ”সেকি সবে তো পৌনে সাতটা বাজে এখনই বেরোচ্ছ যে? নাস্তা করবে না?

হাত বাড়িয়ে লোপার গালটা টিপে দিয়ে সুরমা বললো “নাস্তা এয়ারপোর্টে বসেই করে নিবো। আগে শান্তিমতো ওখানে পৌঁছায়” তুই ঠিকঠাক থাকিস আর দ্যাখ ড্রাইভার গাড়ি বের করেছে কিনা। 

মিনিট দশেক পরেই সুরমাকে নিয়ে লাল টয়োটাখানা ঢাকার রাজপথ দিয়ে হুশ করে ছুটে গেলো। গাড়িতে বসে সে দেখতে পেলো এই সকালে যানজট তেমন না থাকলেও লোকজন ভালোই দেখা যাচ্ছে।  জীবনের তাগিদে সাতসকালে ঘুম ফেলে সব ছুটছে নানা প্রয়োজনে। সুরমার কোলের উপর ছোট্ট একটা প্যাকেট। আসবার সময় লোপা জোর করে ধরিয়ে দিলো। 

ওতে নাকি চিকেন স্যান্ডউইচ আছে, কাল রাতেই বুদ্ধি করে বানিয়ে রেখেছিলো। দিনে দিনে বড্ডো মায়ার বাঁধনে বেঁধে ফেলছে তাকে মেয়েটা।  

লোপা সুরমার বড় বোন সুষমার একমাত্র মেয়ে। সুষমা তার থেকে মাত্র  ২ বছরের বড় ছিল, তবু দ্বিতীয়বার সন্তান জন্মের জটিল পথ পাড়ি দিতে গিয়ে অকালেই নিভে গেলো। বড় সাধ করে বাবা তাদের দুবোনের নাম রেখেছিলেন , সুরমা আর সুষমা। মায়ের মুখে শুনেছে  দাদির সাথে এই নিয়ে নাকি বাবার খুব একচোট হয়ে গিয়েছিলো। দাদির কথা ছিল মুসলমানের মেয়ের কেন হিন্দু নাম থাকবে ? আর শিল্পমনা বাবার এককথা নামের আবার হিন্দু-মুসলমান কি? ও দুটো বাংলা শব্দ।  আর আমার মেয়েদের ওই নামটাই বহাল থাকবে। 

দাদি অবশ্য তাতে গলেন নি….মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাদের দুইবোনকে সে তাহমিনা আর তারান্নুম বলেই ডেকে গিয়েছেন। 

মায়ের মন রাখতে বাবাও স্কুলের খাতায় তাহমিনা চৌধুরী সুষমা আর তারান্নুম 

চৌধুরী সুরমা লিখিয়েছিলেন। সবচাইতে ছোট ভাই জন্মালে বাবার নামের সাথে মিলিয়ে তার নামটা  অবশ্য দাদিই রাখেন চৌধুরী হাসান মাসুদ।  সবাই তাকে হাসান বলেই ডাকে।  

আজ দাদি আর বাবা দুজনার কেও বেঁচে নেই। না থেকে কি ভালোই হয়েছে? তারা কি সহ্য করতে পারতেন আদরের তাহমিনা বা সুষমার অকালমৃত্যু? সুষমা যখন মারা যায় তখন  সুরমারও সবে ডিভোর্স হয়েছে। মা ভাই সবাই জোড়াজুড়ি করেছিল লোপার বাবার সাথে তাকে আবার বিয়ে দেবার জন্য।  কিন্তু ততদিনে সুরমার পুরুষ জাতটির উপর প্রবল আক্রোশ জমে গিয়েছিলো। কিছুতেই আবার সেই কাঁটা বিছানো পথে সে হাটতে রাজি হয় নি।  তার বদলে দু’হাতে আগলে নিয়েছিল ৪ বছরের লোপা কে। 

সেই থেকে লোপা তার কাছেই আছে। প্রথমদিকে মা তার সাথেই থাকতেন, পরে ভাইয়ের ছেলেটা জন্মাবার পর মা এখন বেশি মিরপুরেই থাকেন । আর এখন তো বড় হয়ে লোপাই তার সবরকম খেয়াল রাখে।  সুরমা জানে না সে লোপার মা হয়ে উঠতে পেরেছে কিনা তবে এটা জানে খুব কাছের বন্ধু তারা দুজনে দুজনার। 

এগুলো ভাবতে ভাবতেই কখন যেন গাড়ি এয়ারপোর্টে ঢুকে গিয়েছে সুরমা লক্ষ্যই করেনি। গাড়ি থেকে নেমে ড্রাইভারকে বিদায় দিয়ে ছোট্ট ট্রলি স্যুটকেসটা টেনে ভেতরে ঢুকলো সে। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আকাশপথে ভ্রমণের সব গৎবাঁধা টুকটাক আনুষ্ঠানিকতা সেরে যখন সে ঝাড়া হাত পা তখন ঘড়ির কাঁটা প্রায় ৮ ছুঁই ছুঁই। 

ঠিক ৯টায় প্লেন ছাড়বে। হাতে প্রায় ঘন্টাখানেক সময় আছে। এখন সকালের নাস্তাটা সেরে নেয়া যেতে পারে।  লোপার দেয়া স্যান্ডউইচ তো আছেই সাথে একমগ কফি হলেই জমে যাবে। 

ওয়েটিং এরিয়ার আশপাশ দিয়ে বেশ কয়েকটা ছোট ছোট দোকান আছে। টুকটাক নাস্তা, খবরের কাগজ, পানি এইসব দিয়ে ভর্তি… তারই একটার কাউন্টার থেকে গরম গরম একটা কফি নিলো ও । দুশো মিলির ছোট্ট একটা কাগজের কফিকাপের  বিনিময়ে কড়কড়ে ১৫০ টাকা গুনতে হলো।  মেজাজ বেশ খারাপই হলো…যাত্রীদের সুবিধার জন্যই এয়ারপোর্টের ভেতরে এই দোকান আবার সুযোগ বুঝে তাদেরই পকেট সাফা করার চিন্তা।

এরই মধ্যে বার দুই লোপার ফোন এসেছে ঠিকমতো পৌছালো কিনা জানতে চেয়ে। তাকে আশ্বস্ত করে কফি হাতে নিজের জায়গায় ফিরে সবে স্যান্ডউইচে একটা কামড় বসিয়েছে। হঠাৎ যেন সুরমার হৃৎপিন্ড খানা সজোরে ধড়াস করে উঠলো। কফি একটু ছলকে পড়লো কি ?

ওটা শাহেদ না…..? হ্যাঁ, তাইতো শাহেদই তো।  না তার চোখ কিছুতেই ভুল দেখতে পারে না।  জীবনের ৫ বছর ৩ মাস যার সাথে সে কাটিয়েছে এক ছাদের নিচে  তাকে ভোলা কি এতটাই সহজ ?

যদিও শাহেদের বেশ পরিবর্তন হয়েছে।  একটু যেন শরীরে মেদ জমেছে, চোখে ভারী চশমা আর মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। কাপড়চোপড়ও বেশ কেতাদুরস্ত গোছের।  স্যুট,কোট,টাই হাতে ব্রিফকেস। 

যাকগে মরুকগে তাতে সুরমার বয়েই গেছে। মাথা নিচু করে কফিতে চুমুক দিলো সুরমা। মনের অজান্তেই বারবার চোখ চলে যাচ্ছে ওদিকে। সুরমা জোর করে নিজেকে সংযত করলো।  তের বছর আগে কলমের খোঁচায় ঐমানুষটার সাথে সমস্ত সম্পর্ক শেষ করেছে সে।  ওর জন্য তার কোনো ধরণের ভাবাবেগ  বাকি থাকতে পারে না , ভালোবাসা তো দূর, ঘৃণা এমনকি কৌতূহলও না। 

তবু কেন ওই মানুষটাকে দেখার পর থেকেই বুকটা ধুকধুক করছে ….ঠিক সেদিনের মতো!

প্রায় উনিশ বছর আগের এক সন্ধ্যায় ফিরে গেলো সুরমা। তখন সে সবে ইন্টার পাশ করেছে। মামা-মামী মাকে জানিয়েছে  তাঁরা চায়  সুরমা তাদের সাথে ঢাকায় এসে থাকুক। ওখানকারই কোনো মহিলা কলেজে ভর্তি হয়ে অনার্স করে ফেলতে পারবে। একইসাথে গানের তালিমও নিতে পারবে সুযোগ্য কোনো ওস্তাদের কাছে। 

এই প্রস্তাবে বাবা-মা সুরমা সবাই রাজি। শুধু সুষমা আর দাদি বাগড়া বাঁধিয়েছিলো।  দাদির মন্তব্য ছিল আইবুড়ো মেয়ে পড়তে অতদূর কেন যাবে ?এখনই আসল সময় দুইমেয়েকে পাত্রস্থ করার। আর গান বাজনা এখন ছাড়তে হবে। 

সুষমার ব্যাপারটা অন্যরকম ছিল। সে চাইছিলো না বোন তার কাছ থেকে দূরে যাক, সেই ছোট্টবেলা থেকে একটাই তো সঙ্গী তার। 

বাবা অবশ্য কারো কথায় কর্ণপাত করলেন না , ছোটবেলাতে সুরমার সুরেলা কণ্ঠস্বর আবিষ্কার করার পর নিজের উদ্যোগেই মাস্টার রেখে তালিম দিয়েছেন। স্কুল-কলেজ বা পাড়ার নানান প্রোগ্রামে তো বটেই জেলা পর্যায়ে গান গেয়ে পুরস্কার জিতে ফিরেছে সুরমা।  তাই বাবা চান গানের জগতে সুরমা আরো একটু সুযোগ পাক , কপালে থাকলে অবশ্যই ভাল কিছু করতে পারবে জীবনে। 

সুরমার ঢাকায় যাবার ব্যাপারে মোটামুটি সব পাকাপাকি হয়ে যাবার পর মায়ের সাথে দুইবোন বেড়াতে গেলো মেঝখালার বাড়ি। যাবার পরেই শুনলো পাশের বাড়ির মেয়ের বিয়ে আর হলুদের অনুষ্ঠান সেদিন সন্ধ্যায়। আয়োজন খালার বাড়ির ছাদেই হচ্ছে… দুপুর থেকেই খুব হইচই চলছে। 

 সুরমাদের আসার খবর শুনে যে মেয়েটির বিয়ে হচ্ছিলো সে আর তার মা এলেন। খালাদের পরিবারের সাথে তাদের তিনজনকেও যাবার অনুরোধ করে গেলেন। 

মেয়েটি মিষ্টি হেসে সুরমা-সুষমার দিকে তাকিয়ে বললো ”তোমরা এসো কিন্তু ভাই , আমার ভীষণ ভালো লাগবে। ”

সন্ধ্যায় সব্বাই লালহলুদ শাড়ি পরে খোঁপায় গাঁদাফুলের মালা বেঁধে ছাদে গেলো হলুদ মাখাতে। সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা, খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ হলে বসলো গানের আসর।  সবাই যে যা পারছে দু-চার লাইন সুরে-বেসুরে  গেয়ে শোনাচ্ছে।  আর বাকি সবাই হাততালি বা টেবিল চাপড়ে হৈ হৈ করে উঠছে। 

নির্ভেজাল আনন্দঘন সেই সন্ধ্যায় সুরমাও যেন ভেসে যাচ্ছিলো। 

একসময় মেজখালা বলে উঠলেন এবার আমাদের আসল গায়িকা সুরমা গান গেয়ে শোনাবে।  এরইমধ্যে ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া খালাতো বোন গড়গড় করে সুরমার গানের কীর্তির কথা বলতে আরম্ভ করে দিয়েছে। অগত্যা সকলের অনুরোধে ঢেঁকি গিলতে হলো। 

”বধূ কোন আলো লাগলো চোখে” দিয়ে শুরু করলো সুরমা।  গান শেষ হতেই তুমুল হাততালি এবং আরো গাইবার অনুরোধ। হঠাৎ কে যেন বলে উঠলো হলুদের সন্ধ্যায় ওই প্যানপ্যানানি আর গাইবেন না দয়া করে..কিছু তালের গান গান আমরাও সাথে কোরাস করি। 

কথা শুনে যেন হাসির তুবড়ি ছুটলো সবার মুখে। 

ঝট করে মাথা ঘুরিয়ে আগুন চোখে সেদিকে তাকালো সুরমা আর তাকাতেই বক্তার চোখে চোখ পড়লো। ফাজিলের মতো তার দিকে তাকিয়ে হাসছিলো ছেলেটা। কিছুটা অপমানিত বোধ করলেও বাকি সবার অনুরোধে একটা আধুনিক আর দুটো চলতি হিন্দি গান অবশ্য শুনিয়েছিল সে। 

পরেরদিন বিয়ের অনুষ্ঠানে এককোনে চুপচাপ বসে ছিল সুরমা। কাওকেই তো চিনে না তেমন। অদূরেই মা আর খালার সাথে সুষমা দাঁড়িয়ে। 

হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন বলে উঠলো ”আপনার গানের গলা কিন্তু সত্যিই চমৎকার ” 

ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখলো কালকের ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে।  বিরক্ত হলো সুরমা। কিন্তু ছেলেটা স্বতঃফূর্ত ভাবে এগিয়ে এসে চেয়ার টেনে বসলো। 

কালকের জন্য আমি দুঃখিত, তবে আপনার ওই গান চাঁদনী রাতে খোলা ছাদে পাশাপাশি বসে শুনতে হয়। অতো লোকের মধ্যে মানায় না। 

সুরমা হেসে ফেললো। হাসি দেখে ছেলেটা বললো, যাক বাবা এখন নিশ্চয় আর রাগ করে নেই।”   

হ্যান্ডশেকের ভঙ্গিতে সুরমার দিকে হাত বাড়িয়ে বললো ” আমি শাহেদ, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছি বুয়েটে, বন্ধুর কাজিনের বিয়েতে এসেছি”

কিছুক্ষন ইতঃস্তত করে সুরমা তার বাড়ানো হাতখানা আলতো করে ধরে বললো, ‘আমি…..”

সুরমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে শাহেদ বললো। “আপনি সুরমা, চমৎকার গান করেন।  গানের পাশাপাশি আপনি আর আপনার হাসি দুটোই অসাধারণ”

সেই শুরু…..তারপর কত দুপুর, কত বিকেল কত সন্ধ্যা যে দুজনে হাত ধরে বসে থেকেছে তার শেষ নেই।  আর প্রায় প্রতিবারেই শাহেদকে গান শোনাতে হতো সুরমার। বছরখানেক এভাবেই চললো। 

এসব বিষয় বেশিদিন চাপা থাকে না। একসময় দু’বাড়িতেই জানাজানি হলো। সুরমাদের বাড়ি থেকে আপত্তির তেমন কোনো কারণ ছিল না। শাহেদ সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে। বুয়েট থেকে পাশ করে করে বের হচ্ছে সুতরাং ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। 

বাঁধা আসলো শাহেদের পরিবার থেকে। কিন্তু একমাত্র ছেলের প্রবল জেদের কাছে হার মানলো তারা। অবশেষে বেশ ঘটা করেই বিয়ে হলো তাদের। বাসর ঘরেও শাহেদকে দু’দুটো গান গেয়ে শোনাতে হয়েছিল। 

প্রথম দুইটা বছর যেন স্বপ্নের মধ্যেই কেটে গেলো তাদের। পড়াশোনার কারণে দুজনকেই ঢাকা থাকতে হতো। তাই ছোট্ট একটা দু’কামরার ফ্লাট ভাড়া করে নিলো তারা।  ভালোবাসায় ভালোবাসায় ভরিয়ে তুলেছিল দুজনে ছোট্ট সেই নীড়টাকে। প্রায়ই ফেরার পথে সুরমার জন্য বেলি বা বকুল  ফুলের মালা নিয়ে ফিরত শাহেদ। সেই মালা খোঁপায় জড়িয়ে শাহেদের কাঁধে মাথা রেখে বারান্দায় বসে গল্প করতো দুজনে। হাতে থাকতো ধূমায়িত চায়ের কাপ। 

ম্যাম, আপনার সাথে একটা ছবি তুলি? অতীতের ঘোর ভেঙে চোখ তুলে তাকালো সুরমা।  সামনে দাঁড়িয়ে আছে বছর বাইশের দুই তরুণী। 

আপনি সুরমা চৌধুরী তো.. দেখেই চিনতে পেরেছি।আমরা আপনার গানের ভীষণ ভক্ত … একটা ছবি তুলি প্লিজ?

সুরমা হেসে উঠে দাড়িয়ে বললো, ”হ্যাঁ অবশ্যই”

দুই তরুণী দুইপাশে দাঁড়িয়ে ঝটপট দুতিনটে সেলফি তুলে বহুবার শোনা কিছু প্রশংসা বাক্য শুনিয়ে বিদায় নিলো। সুরমা দেখলো তার হাতের কফি ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে।  অদূরে থাকা ময়লার ঝুড়িতে কফির কাপ ফেলে নিজের জায়গায় ফিরে আসতেই দেখতে পেলো তার চেয়ারের সামনের সারিতে বসে থাকা শাহেদ ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। 

তেরো বছর পর আবারো সেই চোখ…. সেই দৃষ্টি, ভেতর থেকে যেন কেঁপে উঠলো সুরমা। নিজেকে সামলে চুপচাপ নিজের আসনে বসলো। শাহেদও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ততক্ষনে। 

মিনিট পাঁচেক পর উঠে এসে সুরমার পাশের চেয়ারে বসলো।  নরম গলায় বললো ”কেমন আছো সুরো ?”

সুরো ….! লোকটা কি ভুলে গিয়েছে সে এই বিশেষ নামধরে ডাকার অধিকার অনেকদিন আগেই সে নিজহাতে শেষ করেছে? 

গোপনে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে  স্মিত স্বরে জবাব দিলো, ”ভালো, তুমি কেমন আছো ?

হ্যাঁ , তা আছি ভালোই। বছর তিনেক আগে ব্লাডপ্রেশার আর সুগার ধরা পড়েছে।  তাছাড়া বাকিসব বেশ কেটে যাচ্ছে। 

একটু অবাক হলো সুরমা।  কত আর বয়স শাহেদের ? এখন চুয়াল্লিশ হবার কথা….এরইমধ্যে রক্তে সুগার-প্রেশারের মতো নীরব ঘাতক জুটিয়ে নিয়েছে। 

সুগার পেশেন্ট কে তো অনেক বাছবিচার করে খাবার খেতে হয়।  শাহেদ যে পরিমানে ভোজনরসিক ও কি পারছে সব মেনে চলতে ? 

নিজের উপর বিরক্ত হলো সুরমা।  কি সব ভাবছে সে, এখন আর তার ওর জন্য উদগ্রীব হওয়া সাজে না। নিশ্চয় ওর দেখভাল করার মানুষ আছে। 

শাহেদই আবার কথা বললো, তুমি তো এখন বেশ জনপ্রিয়। আমি খুব শুনি তোমার গান। আমার অফিসের লোকজনও অনেক তোমার ফ্যান। ইনফ্যাক্ট একটু আগে আমি গাড়িতে তোমার গাওয়া গান শুনতে শুনতে এলাম। 

সুরমার বুকের ভেতরটা যেন মুচড়ে উঠলো।  কি বলছে কি মানুষটা!  ওকি ভুলে গিয়েছে সব? এই গানের জন্যই তো সারাজীবন পাশাপাশি থাকার ওয়াদা করেও আজ দুজনে দুটি অচেনা মানুষে পরিণত হয়েছে। 

একদিন হঠাৎ করেই সুরমাকে ডেকে থমথমে গলায় বলেছিলো,  গান গেয়ে নষ্টামি করা বন্ধ করতে হবে। গান গাইতে পারে তবে সেটা শুধুই  শাহেদের জন্য। 

সুরমার একটুও আপত্তি ছিলোনা তাতে, আপত্তি ছিল শুধু তার বলার ভঙ্গিতে, নোংরা ইঙ্গিতে।  দিনে দিনে ব্যাপারটা যেন ক্রমশ বেড়েই চলছিল।  গান গাওয়া বন্ধ করলেও অতীতের কথা টেনে নোংরা ভাষায় বারবার সুরমার মনটাকে ভেঙে চৌচির করে দিতো সে। 

যে শাহেদকে ভালোবেসে একরাশ স্বপ্ন নিয়ে ভালোবাসার ঘর সে বেঁধেছিলো, একটু একটু করে যেন তার মুখোশ ঝরে বেরিয়ে আসছিল আসল বীভৎস মুখ। ছোট ছোট কারণে দুর্ব্যবহার, অকথ্য গালাগাল শেষতক গায়ে পর্যন্ত হাত তুলেছে। 

কি যে অশান্তিতে কেটেছে শেষের  দু-দুটো  বছর।  তবু  সুরমা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে গিয়েছে।  অপেক্ষা করেছে, চেষ্টা করেছে পুরোনো শাহেদকে ফেরত আনার। বারবার বলেছে সে গান ছেড়ে দিবে।  বোঝাতে চেয়েছে এই পৃথিবীতে শাহেদের চেয়ে বেশি আর কোনো কিছুতেই তার আসক্তি নেই।

কতবার যে একটা সন্তান নেবার কথা বলেছে…যদি তাতে ঠিক হয় সব।  

মাঝে মাঝে যেন সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যেত, সংসারে শান্তি ফিরে আসতো।   আবার হঠাৎ হঠাৎ কি যে হতো শাহেদের… সেই একই ভয়াল মূর্তি, নোংরা  সন্দেহ, রক্ত গরম করা বাক্যবাণ।  

একদিন সহ্য করতে না পেরে এক কাপড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল সুরমা। নাহ, ফিরেও তাকায় নি আর শাহেদ। রাগ ভাঙিয়ে নিতে আসা তো দূর বরং দু সপ্তাহের মাথায় ডিভোর্সের নোটিশ চলে এলো। যেন তার ঘর ছাড়ার অপেক্ষায় ছিলো সে। 

ভীষণ অভিমানে বুকে পাথর জমলো সুরমার। ঠিক আছে তবে তাই হোক।  মা-বোন-ভাই সবার অনুরোধ-উপরোধ যুক্তি ঠেলে ফেলে ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিলো সে। পাঁচবছর তিনমাসে গড়া ভালোবাসার তাজমহল একটা ঠুনকো কলমের কালির আঁচড়ে ভেঙে খান খান হয়ে গেলো। 

ছাড়াছাড়ির পর গানকেই ধ্যান-জ্ঞান করে নিলো সুরমা। এর মাস ছয়েক পরে দ্বিতীয়বার বাচ্চা প্রসবের জটিলতায় চারবছরের মেয়ে ফেলে অকালে চলে গেলো সুষমা। সেই থেকে লোপাকে আঁকড়ে আর গান নিয়ে পার করে দিলো তেরটা বছর। আজ সে সফল গানের জগতেও আর লোপার মা হিসেবেও।

আর সেই শাহেদ আজ কিনা সুরো থেকে শিল্পী সুরমা চৌধুরী হয়ে ওঠা সুরমার গানের প্রশংসা করছে? এরই নাম কি তবে জীবন?

কি ভাবছো? কিছু বলছো না যে সুরো? – ঘুরে বসলো শাহেদ 

অনেকক্ষন ধরে মনের কোণে জমে থাকা প্রশ্নটা শেষ পর্যন্ত করেই ফেললো সুরমা, ”বিয়ে করেছো?”

একটু যেন উদাস ভঙ্গিতে জবাব এলো “নাহ, ইচ্ছে হয় নি” তারপর আবারও  প্রশ্ন ধেয়ে এলো ”তুমি করেছো ?”

এবার সরাসরি শাহেদের চোখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি এঁকে কেটে কেটে বললো ”একবারেই যে শিক্ষা পেয়েছি তাতে দ্বিতীয়বার আর শখ চাপে নি”

কিছুক্ষন যেন নীরবতায় কেটে গেল। একটু পরে অস্ফুটে শাহেদ বলে উঠলো “তুমি এখনো আগের মতোই সুন্দর আছো সুরো, চাইলে তো নতুন করে আবার শুরু করতে পারতে , কত শখ ছিল তোমার একটা বাচ্চার।“

সুরমা যেন বিহ্বল ! বিমূঢ় ! তারপর হঠাৎ করেই হাতব্যাগ খুলে মোবাইলটা বের করে লোপার ছবি  শাহেদের সামনে মেলে ধরলো।  লোপার কথা মনে আছে তোমার ? বড়পা’র মেয়ে।  বড়পা মারা যাবার পরথেকে ১৩ বছর ধরে আমিই বড় করে তুলেছি ওকে।  আমি এখন ওর মা, ও আমার মেয়ে।  আমার আর কোনো শখ অপূর্ন নেই শাহেদ।  আমি বেশ আছি।   

মাইকে নারীকন্ঠের ঘোষণা শোনা গেলো, নয়টার ফ্লাইটের যাত্রীদের নিজ নিজ আসন গ্রহণ করতে মিষ্টি স্বরে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে সে। সুরমা উঠে দাঁড়ালো। হাতব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে এগিয়ে গেলো দুপা। তারপর আবার কি মনে করে ফিরে এসে কোমল স্বরে শাহেদকে বললো ” আমার জন্য ভেবো না, আমার লোপা আছে।  তুমি ভালো থেকো আর শরীরের যত্ন নিয়ো। পারলে আবার জীবন নিয়ে নতুন করে ভাবো। কিইবা বয়স হয়েছে তোমার ?জীবনের অনেকটা পথ এখনো বাকি….একা একা  কিভাবে কাটাবে?  আর এরই মধ্যে তো দুটো বিদঘুটে রোগ বাঁধিয়ে  নিয়েছো। কেউ একজন তো দরকার যে তোমাকে দেখে রাখবে। চলি”

শূন্য দৃষ্টিতে সুরমার চলে যাওয়া দেখছিলো শাহেদ। নীল শাড়ি পড়া ওই রমণী একদিন শুধু তারই ছিল , তার একেবারে নিজস্ব ! কিন্তু আজ সে শাহেদের কেউ না। যেমন এই ওয়েটিং এরিয়ার মানুষজন কেও তার নিজের না। ভিড়ের মধ্যে থেকেও শাহেদ যেন বড় একা হয়ে গেলো।   

চোখের সামনে পুরোনো দৃশ্যপট গুলো ভেসে উঠলো। বিয়ের পরের  দিনগুলো  বেশ কেটে যাচ্ছিলো তাদের, ভালোবাসার ভেলায় ভাসতে ভাসতে প্রায় আড়াই বছর কেটে গিয়েছে চোখের পলকে। এরইমধ্যে পাশ করে বের হতেই শাহেদের বেশ ভালো একটা চাকরি হয়ে যায়।  সুরমারও অনার্স শেষের দিকে।  গান-বাজনাও ভালো চলছে। টিভি বা রেডিওতে টুকটাক প্রায়ই ডাক পায় গান গাইবার জন্য। কিন্তু অতটুকুই, ভাগ্যের শিঁকেটা যেন খুলেও খুলছিল  না। 

মাস চারেক আগে বড় শালী সুষমার একটা মেয়ে হয়েছে। সুরমাই নাম রেখেছে লোপা। বোনের মেয়েকে দেখতে যখন তখন ছুটে যাচ্ছে বনশ্রীতে। ফেরার পরে শুধুই লোপা নামের ওই ফুটফুটে পুতুলটার গল্প।  জানো আজ কি হয়েছে ? লোপা এই করেছে , লোপা সেই করেছে।  একদিন তো এসে বললো, ”লোপা আজ  আমাকে দেখে খালামনি বলে ডেকেছে।” 

হাসতে হাসতে শাহেদ বলল চারমাসের বাচ্চা তোমাকে খালামনি ডেকেছে ? আর সেটা তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে বলো ?

মুখ বাকিয়ে সুরমা জবাব দিলো , হ্যাঁ স্পষ্ট করে করে বলে নি তবে ওটার মানে ওটাই ছিল। আমি বুঝতে পারি। 

তারপর হঠাৎ করে হাত বাড়িয়ে শাহেদের গলা জড়িয়ে ধরে লাজুকমুখে বললো, ”লোপার মতো একটা পুতুল কি আমরাও নিতে পারি না?”

সেতো পারিই , তবে তোমার গান পড়াশুনা এগুলোর কি হবে ? সুরমার কোমর জড়িয়ে ধরে প্রশ্নটা করেছিল সে। 

হবে সবই হবে আস্তে আস্তে, কিন্তু আমার এখন একটা বেবী চাই।  

”যথা আজ্ঞা সুরো রানী” আলতো হাতে সুরমার নাক টেনে বলেছিলো সে।  

তারপর থেকে সুরমার সেকি উচ্ছাস। বাজারে গেলেই দুচারটে এটা ওটা বাচ্চাদের জিনিস কিনে আনতো। মাটির ব্যাংকে রোজ কিছু না কিছু পয়সা ফেলে জমাতে লাগলো। নিয়ম করে ডাক্তারের কাছে যেতে লাগলো। 

অবাক হয়ে শাহেদ বলেছিলো, তুমি এখনই ডাক্তারের কাছে যাও কেন ? 

দরকার আছে মশায় আমার শরীরের কলকব্জা সব ঠিক আছে কিনা দেখতে হবে না? আমার কোনো রোগ থেকে থাকলে তা তো বাচ্চারও  ক্ষতি করতে পারে।  তাই আগেভাগে সেগুলোকে ঝেটিয়ে বিদেয় করতে হবে যে। 

তুমিও পারলে নিজের চেকআপ করিয়ে নিও। বিজ্ঞের মতো মাথা দুলিয়ে বলেছিলো সুরো। 

কথাগুলো বেশ মনে লেগেছিলো তার। তাই একদিন ডাক্তার বন্ধুর চেম্বারে গিয়ে প্রয়োজনীয় সমস্ত চেকআপ করিয়ে নিয়েছিল সে। আর সেটাই বুঝি কাল হলো। রিপোর্ট বলছে শাহেদের বাবা হবার কোনো ক্ষমতা নেই, সৃষ্টিকর্তা তাকে এই সৌভাগ্য দেননি। পাহাড় সমান দুঃখ আর হতাশা নিয়ে ঘরে ফিরেছিল সে।  ফিরেই সুরমার হাস্যোজ্জ্বল মুখ আর স্বপ্নমাখা চোখ দেখে দমে গিয়েছিলো। কোনোভাবেই তাকে সেটা বলতে পারে নি শাহেদ। 

অনেকবার ভেবেছে আজ বলেই দিবো কিন্তু শাহেদের পুরুষ মন আর সুরমার উচ্ছাস বারবার তাকে বাঁধা দিয়েছে। 

একদিন সুরমাকে সে বলেছিলো, এই যে সারাদিন লোপা লোপা করো, সুযোগ পেলেই দৌড়ে চলে যাও।  তা ওকে একেবারে নিয়ে আসো না কেন ? তাতে তোমার বাচ্চার শখ মেটে। 

নিয়ে আসতে চাইলেই বুঝি বড়পা দিয়ে দিবে ? আর যদি দেয়ও, ও কি আর তাই আমার সন্তান হবে ? আমি আমার নিজের চাই, একদম নিজের। 

কথাটা শোনার পরেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলো শাহেদ। সুরমার এই চাওয়া কোনোদিন পূরণ হবে না যতদিন সে তারসাথে থাকবে। সৃষ্টিকর্তা তাকে অপূর্ণ রেখেছেন, সুরমাকে নয়। কোন দাবিতে সারাজীবন সে নিজের সাথে  সুরমাকেও বঞ্চিত করে যাবে ? শাহেদ ভালো করেই জানতো সত্যি কথাটা সুরমাকে বললে ও হয়তো সমস্ত আকাঙ্খা বিসর্জন দিয়ে তার পাশেই থাকবে। 

বিনা বাক্যব্যায়ে  যে মেয়ে তার সারাজীবনের স্বপ্ন গান ছেড়ে দিতে চায়  শুধু  শাহেদ এর জন্য , তাকে সে জেনেবুঝে কিছুতেই অপূর্ণ রাখতে পারে না। 

দিনে দিনে শাহেদ নিজেকে গুটাতে থাকে, সবরকম চেষ্টা করে সুরমাকে দূরে সরানোর….তবু বারবার তাকেই আঁকড়ে ধরতে চাইতো সুরমা। 

কিন্তু একদিন শাহেদ সফল হয়, ঝগড়ার পর রাগ করে বাড়িছেড়ে চলে যায় সুরমা। কিছুদিন পরেই আগে থেকে তৈরী করে রাখা ডিভোর্সের নোটিশ পাঠিয়ে দেয় ওকে। ততদিনে সুরমাও হয়তো তাকে ঘৃণা করতে শিখে গিয়েছিলো, নাহলে একবারও তাকে কেন বোঝাতে এলো না। চটপট সাইন করে পাঠিয়ে দিয়েছিলো। আর এভাবেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো তাদের সম্পর্ক। 

শাহেদও কিছুদিনপর স্কলারশীপ নিয়ে আমেরিকায় পাড়ি জমায়। দীর্ঘ ১০বছর ওখানে কাটানোর পর বছর তিনেক হলো পাকাপাকি ভাবে  ফিরে এসেছে। ওখানে থাকতেই সে জানতে পেরেছে সুরমার সাফল্যের কথা।  তখন যতবার দেশে এসেছে  সাথে করে সুরমার সব গানের ক্যাসেট,সিডি নিয়ে যেত। একাকী প্রবাসে সুরমার গানের সাথে যেন সে খোঁপায় জড়ানো বেলিফুলের মালার সুবাস পেতো।  আর ভাবতো হয়তো সুরমা সুখেই আছে। 

কিন্তু আজ হঠাৎ করে দুজনার দেখা হয়ে যাওয়াতে শাহেদ বুঝতে পারলো সে ভুল করে ফেলেছে। বড় বেশি ভুল করেছে।  এমনটাতো সে চায়নি।  সেইতো সুরমা একাই আছে , অন্যের সন্তানকে নিজের বুকে টেনে মাতৃত্বের স্বাদ নিচ্ছে।

কিন্তু সে নিজে? সেতো আরো একা, একদম খালি হাত। 

এতদিন সে নিজেকে এই বলে সান্তনা দিতো যে ” ভালোবাসার ঋণ শোধ করেছি আমি। ” কিন্তু আজ বুঝলো কত বড় বোকামীটাই না সে করেছে। 

সুখে থাকতে সব চাহিদা বা চাওয়ার পূর্ণতার দরকার হয় না, বরং হাজার অপুর্ণতার মাঝে একজন সঙ্গী যদি পাশে থাকে শক্ত করে হাত ধরে থাকে সেটাকেই আসল পূর্ণতা বলে। 

আজ লোপা তাদের দুজনের মেয়ে হয়ে উঠতে পারতো। লোপাকে ঘিরে   ছোট্ট একটা সুখের সংসার থাকতো তাদের। 

সবকিছু শাহেদ নিজ হাতে ভেঙেছে যা আর এখন জোড়া লাগার নয়। 

আবারো কি ফিরে যেতে পারেনা সুরমার কাছে ? কিন্তু কি হবে গিয়ে? সেকি আর সেই আগের সুরমাকে পাবে না সুরমা পাবে আগের শাহেদ কে?

মাঝখান দিয়ে যে অনেকগুলো বছর কেটে গিয়েছে, বয়ে গিয়েছে সময়ের স্রোত। 

সময়, হ্যাঁ এই সময় ই যে মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রূ।  এই সময়ই তাদের দুজনার মধ্যে অনেকখানি দূরত্ব এনে দিয়েছে যা এখন পূরণ করা অনেকটা অবাস্তব। তার থেকে এই ভালো, যেমন আছে তেমনি চলুক। এই এয়ারপোর্টের সময়টুকুর মতো জীবনের একটা অংশ তারা পরস্পরের সান্নিধ্যে কাটিয়েছিলো।  তারপর যে যে যার যার মত একলা নিজ গন্তব্যের উদ্দ্যেশে উড়াল দিয়েছে। এখন আবার নতুন করে এক হতে হলে বহুপথ পাড়ি দিতে হবে। সেই সময় কি আর আছে ?

মাইকে আবারো সুরেলা কণ্ঠস্বরে ঘোষণা ভেসে এলো। সকাল সাড়ে নয়টার সিলেটগামী যাত্রীদের নিজ নিজ আসন নেবার আহবান জানাচ্ছে তারা। শাহেদ পাশে রাখা ব্রিফকেসটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো নিজ গন্তব্যের অভিমুখে। 

                                       ……………………………………………

আয়শা ছিদ্দিকা

১৪.০২.২০২১,

হ্যানোফার ,জার্মানি।  

Exit mobile version